সৈয়দ আহমাদ তারেকঃ মেট্রোরেল এর বিয়ারিং দূর্ঘটনায় গতকাল ওয়ার্কিং আওয়ারে আবুল কালাম মরে গেলেন। রাস্তায় নিরীহভাবে পড়ে থাকা বাতাস ভর্তি জুসের প্যাকেট এর মতো আবুল কালাম মরে গেলেন। রাস্তায় নিরীহভাবে পড়ে থাকা বাতাস ভর্তি জুসের প্যাকেট যেভাবে মানুষ পা দিয়ে ফুটায়, তাকে সেভাবে ফুটিয়ে দিয়েছে মেট্রোরেলের বিয়ারিং। তার মৃত্যু হয়েছে মুহূর্তে। অসুখে ভুগে পীঠে বেড সোর নিয়ে তাকে মরতে হয়নি, অন্য অনেক দুর্ঘটনায় মৃতদের মতো নিশ্চিত মৃত্যকে ফাঁকি দিতে তাকে অহেতুক অস্থির হতে হয়নি, ভোগ করতে হয়নি মৃত্যুর অসহনীয় আতংক। কে জানে যন্ত্রণাও কম হয়েছে কিনা?
শুধু মৃত্যুর ধরণ ও মুহুর্তকে বিবেচনায় নিলে, আবুল কালাম বোধহয় ভাগ্যবান।
পৃথিবীতে বিনিময় ছাড়া কিছুই ঘটে না। আবুল কালামের ভাগ্যের ঋণের সুদ আজীবন দিতে হবে তার স্ত্রী ও নিষ্পাপ শিশু সন্তানকে। বাংলাদেশ ক্ষমতাবান ও শুয়োরের বাচ্চাদের জন্য জান্নাত। আর আমাদের মতো ফকিন্নির বাচ্চাদের জন্য এটা জাহান্নামের একটা ডামি ভার্সন। আবুল কালাম তার অল্প বয়সী স্ত্রী ও দুইটা শিশু বাচ্চাকে রেখে গেলেন জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থরে।
অতি ক্ষুদ্র যে পিঁপড়া, তাকে পায়ে ডলা দিলেও দেখা যায় মৃত্যুর পূর্বে সে হাত পা নাড়ানোর চেষ্টা করছে। আবুল কালাম সেই সুযোগটাও পাননি। তার স্ত্রী আইরিন যখন মাছের বাজারে যাবেন, দেখবেন তার রুই মাছটা কাটার আগে একজন মাছের মাথায় মুগুরের ঘা দিয়ে মাছকে অবশ করছে। তাৎক্ষনিকভাবে তার মনে হবে, মুগুরটা পড়ছে আবুল কালামের মাথায়।
আবুল কালামের বাচ্চারা স্কুলে ভর্তি হবে। জার্নি বাই ট্রেন রচনা লিখতে গেলে হাতের আংগুলে কাঁপুনি দেবে তাদের। মনে হবে, এমনই কোনো এক ট্রেনের ঝামেলায় তাদের বাবা পঁচা মিষ্টি কুমড়োর মতো অবহেলায় পড়া ছিলেন ঢাকার রাজপথে।
তারা আরো বড় হবে, ঢাকায় আসতেই হবে তাদের। ততদিনে ঢাকা ছেয়ে যাবে মেট্রো নেটওয়ার্কে। তাদের উঠতে হবে মেট্রোরেলে। মেট্রো ফাঁকি দিতে চাইলেও লাভ হবে না। গাড়ি রিকশা বা পায়ে হাঁটার সময় মাথার উপরে উঁকি দেবে এই বস্তু। আবুল কালাম ঘোরপাক খাবেন তার সন্তানদের মাথায়।
আবুল কালামের সন্তানদের কেউ যদি মানসিকভাবে দুর্বল হয়, কারো যদি দুর্ভাগ্যবশত পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার চলে আসে…বাকি জীবন “ট্রেন” “মেট্রো” “বিয়ারিং” “ফার্মগেট” এমনকি “উন্নয়ন” শব্দটা শুনলেও তাদের বুক ছ্যাৎ করে উঠবে।
প্রত্যেক মানুষের কাছে পিতা মাতার মৃত্যু জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার একটা। অনেকের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ অজস্রবার অসংখ্য মানুষের কাছে বাবা মায়ের মৃত্যুর মুহূর্ত শেয়ার করে, করতে হয়। শোকটা সামলানোর পর বাবা মায়ের মৃত্যুকে বেদনার পাশাপাশি এক ধরনের ভালোবাসার আবেশে স্মরণ করে সবাই।
আবুল কালামের সন্তানরা সেটা পারবে?
“আমার বাবা হাঁটছিলেন। উপর থেকে মেট্রোরেলের যন্ত্র পড়ে মুহুর্তে মরে গেছেন।” কথাটা বলতে গেলে আবুল কালামের বাচ্চারা যতটা কষ্ট পাবে, তারচেয়েও বেশি পাবে লজ্জা।
শরীরের অনিয়ম বা সাংসারিক চাপে হার্ট এটাক -স্ট্রোক করে মরে গেলেও এক ধরনের সান্ত্বনা থাকে। শরীরের অনিয়মে আনন্দ পাওয়া যায়। আনন্দের বিনিময়ে মৃত্যু। সংসারের চাপ নিয়ে মরে যাওয়া গৌরবের ব্যাপার। মৃত্যু যন্ত্রণার, তবুও পরিবারের কেউ তখন পাশে থাকলে বেঁচে থাকা মানুষটা আত্মিক শান্তি পায়। কোনো দায়িত্বরত অবস্থায় চলে গেলে পরের প্রজন্মের গল্প বলার সুযোগ থাকে।
লোকটা কাউকে ধাক্কা দেয়নি, কোনো মিছিলে ঢুকেনি, কারফিউ ভাঙেনি, বেখেয়ালে রাস্তায় নেমে যায়নি, চরম গতির কোনো বাসে বসে সিটে আয়েশে ঘুমিয়ে যায়নি। লোকটা শুধু ঢাকার তুলনামূলক এক নীরব ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছিল।
হায় আবুল কালাম, মানুষের মৃত্যু এত সাধারণ হয়! এত ক্ষুদ্র হয়? এত অগৌরবের হয়?
আবুল কালাম অবশ্য একদিক থেকে ভাগ্যবান বটে, তিনি দামী জিনিসের আঘাতে মারা গেছেন। মেট্রোরেল দেশে আছেই একটা, বহুল আলোচিত ও সম্মানিত বস্তু। গার্মেন্টসের আগুনে, ফিটনেসহীন গাড়ির চাপায় বা অচল লঞ্চ ডুবিতে মরলে তার নাম কেউ জানতো না। কোনো উপদেষ্টা দুই ঘন্টার ভেতরে তার লাশের দাম নির্ধারণ করতেন না। লাশ নিলামে উঠানোর উপযুক্ত কিনা এটা ভাবতেই সময় লাগতো তিনদিন। মিডিয়া ও মানুষ চুপ হলে লাশটা হাতবদল হতো মুফতে।
মাননীয় উপদেষ্টা লাশের দামের পাশাপাশি বোনাস হিসেবে পরিবারের কাউকে চাকরি দেবার কথা বলেছেন। কালামের স্ত্রী আইরিনকে দেখে মোটামুটি শিক্ষিতই মনে হয়েছে। চাকরিটা তারই পাবার কথা।
আইরিনের এই মুহূর্তে মেট্রোরেলের প্রতি গভীর ক্ষোভ ও অভিমান আছে। হয়তো তিনি ভাবছেন মেট্রোরেলের দুই মাইলের কাছেও তিনি কোনোদিন যাবেন না।
কিন্তু চাকরিটা সম্ভবত তাকে করতেই হবে। কর্তাবিহীন এই পরিবারে অভাব অবধারিত। হাত খালি হলেই আইরিন ভেবে দেখবেন, মেট্রোরেল জিনিসটার তো দোষ নেই। আবুল কালামের সাথে বিয়ারিং এর শত্রুতা ছিল না। তিনি সাত পাঁচ ভেবে চাকরি নেবেনই।
তার চাল ডাল আসবে সেই লংগরখানা থেকে যেটা তৈরি না হলে বেচারির স্বামীকে মরতে হতো না। তিনি অদ্ভুত মানসিক টানাপোড়েনে ভুগবেন। ট্রেনের শব্দে খেই হারাবেন সময়ে সময়ে।
তিনি আরো দেখবেন সন্তানকে আদরে হাত ধরে স্টেশনে ঢুকছে কোনো পিতা, তিনি শুনবেন “বাচ্চাদের সামলে রাখুন” এনাউন্সমেন্ট। তারপর চোখ তুলে দেখবেন, তার সন্তানকে সামলে রাখার আসল মানুষটাই আর নাই।
জগতের প্রতিটা মানুষকেই একদিন “নাই” হতে হবে। এই “নাই” নামক জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ নিষ্ঠুর প্রথাকে মেনে নিয়েই আমরা আছি। আবুল কালামদের দুর্ভাগ্য, এদেশে মানুষ এমন করে, এত তুচ্ছ কারণে, এত নির্মমভাবে, এত সহজে “নাই” হতে পারে যেটা জগতের আর কোথাও নাই।
আবুল কালামের মতো কিছু মৃত্যু এ শহরে অবধারিত। প্রতিদিন বেশ কিছু অপমৃত্যুর এলটমেন্ট থাকে। অপমৃত্যু নিশ্চিত, ক্যান্ডিডেট অনিশ্চিত। আবুল কালাম মাথায় বিয়ারিং নিয়ে এক দিনের জন্য আমার বা আপনার মাথা বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আমরা তার কাছে ঋণী ও চিরকৃতজ্ঞ।
ঋণ ও কৃতজ্ঞতা থেকেই প্রার্থনা করি, তার স্ত্রী সন্তানের জীবন সহজ হোক। দ্রুততম সময়ে তারা মানতে পারুক, এদেশে এমন করে মরে যাওয়া দুর্ঘটনা নয়, স্রেফ ঘটনা।
তাদের বুকের ভার হালকা হোক।
মূল লেখা – জয়নাল আবেদীন এর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত।

