নাসির উদ্দিনঃ বাংলাদেশ ও এনসিপি দুটোই আইসিইউতে। টেমস নদীতেও উথাল পাথাল নেই। মানুষ হাঁটছে আত্মঘাতী পথে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার দশা। ভরসা দেশের জনগণ। দলগুলোতে আস্থা নেই। কারণ কেউ রাষ্ট্র গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে রাজনীতি করছেনা। তাদের রাজনীতি কেবল ক্ষমতার উদ্দেশ্যে। রাষ্ট্রকে নিয়ে তাদের চিন্তা বড়ো অসার। নিশ্চিত করেই বলা যায় আপাতত আমাদের আগামী নেই। কারণ মানুষের সমস্যা অর্থনৈতিক কিন্তু সমাধানের পথ দেখানো হয় দলবাজিতে, ধর্মে, কখনো জাতিয়তাবাদে।
ফলে জনগণকেই আবার ওলট-পালট করে দেয়ার দায়িত্ব নিতে হবে। রক্ত ঢেলে আবার হায়েনাদের তাড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করবে। যতদিন রাজনীতিতে চোরকাঁটা থাকবে ততদিন এই প্রক্রিয়াই চলবে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই শূন্যতায় মধ্যযুগ এসে অস্তিত্বের দখল নিয়েছে। সেই মধ্যযুগ যে আকাশটাই চিনেনি। মিথ্যা বলে বলে ফাঁকির বিভীষিকা ছড়িয়েছে অনন্তকাল।
অথচ এই হাভাতে বাঙ্গালির রাজনৈতিক অর্থনীতির লড়াইয়ের শুরু সেই মধ্যযুগেই। রাজা শশাঙ্ক দেব সেই ৬ শ সালে গৌড় অঞ্চলে প্রথম বাঙ্গালী শাসক হয়েছিলেন। অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পথ ধরেই তিনি শাসক হয়েছিলেন। এই বীর ৩৬ বছর বাংলার অধিকাংশ এলাকা শাসন করেছেন। ভাটির বাঘ ছিলেন ফেণীর দরিদ্র পরিবারের শমশের গাজী। ১৭৪৮ সালে চাকলা রোসনাবাদের জমিদার নাসির মাহমুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে রোসনাবাদ পরগনা দখল করে ১২ বছর রাজত্ব করেছিলেন।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহকে ইতিহাস ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা বলে। পুরো ভারত নয়, হিন্দু মুসলমান বন্ধুত্বের বাঙ্গালি শিক্ষিত শ্রেণী, পাঞ্জাবি ও পাঠানদের অগ্রসর অংশই এই বিদ্রোহ করেছিল। এজন্যই আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দী তালিকার ৭০ শতাংশই ছিল বাঙ্গালী। দেশের মর্যাদা ও মুক্তির জন্য তারা যে নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করেছে বিশ্ব ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। এই কারাগারে উল্লাসকর দত্ত, বারীন ঘোষ, ত্রৈলোক্যনাথ রায়, সুবোধ রায়দের মতো অসংখ্য বাঙ্গালী বিপ্লবী ফাঁসিতে ঝুলেছে। দু:সাহসী শের আলী খান আফ্রিদি ও ফজলে হক খয়রাবাদীরাও সেখানেই জীবন বিলিয়েছে। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী বিপ্লবী সিলেটের লৌহমানব হাবিলদার রজব আলী খাঁ’র ১৮৫৭ সালের চট্টগ্রাম বিদ্রোহ বাঙ্গালির বিপ্লবী ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর বিদ্রোহে বিনা বিচারে চট্টগ্রাম কারাগারে হাজারো বন্দী মুক্তি পেয়েছিল।
ব্রিটিশ শাসন শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইতিহাস তো বাংলা এবং পাঞ্জাবেই সীমাবদ্ধ ছিল। কথিত আছে বৃটিশরা এজন্যই এই দুটি রাজ্যকে ভাগ করে দুর্বল করে গিয়েছে। বিভক্ত বাংলার দরিদ্রতম এই ছোট্ট জনপদটি নিজেদের আলাদা অস্তিত্ব সৃষ্টি করতে কিন্তু ভুল করেনি। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল এই বাংলায়। ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ একমাত্র বাংলায় বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনে করেছিল। সেই নির্বাচনে বাংলার ১১৯ টি আসনের মধ্যে ১১৩ টি জিতেছিল মুসলিম লীগ। অথচ পাকিস্তানের পাঞ্জাবে ১৭৫ আসনের মধ্যে ৭৩ টি, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ৫০ আসনের মধ্যে ১৭ টি এবং সিন্ধে ৬০ টি আসনের মধ্যে মাত্র ২৭ টি আসন লাভ করেছিল মুসলিম লীগ। অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র এক বছর আগেও বর্তমান পাকিস্তানে কংগ্রেসের আধিপত্য ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টিতে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলার এই জনগণের অবদান ছিল বেশি। এর প্রধান কারণ এই অঞ্চলের জামিদারি শোষণ নিপীড়ন ও জাত পাতের ঘৃণিত অতীত। বাংলার মুসলমান ও দলিত হিন্দুদের সম্মিলিত উত্থানের পেছনের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই জনগণ ১৯৪৭ সৃষ্টি করেছিল। এমনকি ১৯৭১ সৃষ্টির পেছনেও অর্থনৈতিক বৈষম্যই ছিল মূখ্য কারণ।
১৯৪৭ সালের দেশভাগে দরিদ্র বাঙ্গালীদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। কিন্তু বাংলা ছিল অরক্ষিত ও উম্মুক্ত। বাংলার সীমান্তের কোথাও কোনো সীমান্তরক্ষী ছিলো না। দেশভাগের পর সাধারণ মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে নিজের এলাকায় সীমান্ত পাহারা দিয়েছে। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত প্রথম দিন থেকেই ছিল সুরক্ষিত। এ বিষয়ে বাউবি’র বর্তমান উপ উপাচার্য অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌসের বিস্তারিত গবেষণা রয়েছে।
বাংলার বঞ্চনার আরেক নাম ত্রিপুরা। ভারতের বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্য এবং বৃহত্তর কুমিল্লা বৃহত্তর নোয়াখালী, রাঙ্গামাটি ও মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া নিয়ে ছিল এই রাজ্য। ১৯৪৭ সালে রাজ্যটির শেষ রাজা ছিলেন কিরিত বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর দেব বর্মা। তিনি ত্রিপুরাকে অবিভক্ত রাখতে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ত্রিপুরার রাজার আগ্রহকে অগ্রাহ্য করেন। তার যুক্তি ছিল ত্রিপুরার অধিকাংশ সমতল এরিয়া পাকিস্তানের অংশ হয়েছে। পাহাড়ি অংশ পাকিস্তানের প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক মূর্খতায় ত্রিপুরাও বিভক্ত হয়। দেশভাগের দুই বছর পর ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে ত্রিপুরাকে ভারতে যুক্ত করার সম্মতি প্রদান করেন ত্রিপুরার রাজা।
পরিণতিতে আজকের বাংলাদেশ এক বিশাল ভূখণ্ড থেকে বঞ্চিত হয়। আর ত্রিপুরার রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে ৭০ হাজার মুসলমান পরিবারকে ত্রিপুরা থেকে উচ্ছেদ করেন। এদের অনেকের বিশাল সম্পত্তি ছিল পাহাড়ি অঞ্চলে। সেই সম্পত্তিসহ সর্বস্ব হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যায় এসব পরিবার। মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাম্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনী এলাকার এসব মানুষের ঘরবাড়ি জমি ছিল পাহাড়ি ত্রিপুরায়। তাদের সবাইকে উচ্ছেদ করে ত্রিপুরা সরকার। দেশভাগের পর তাদের পরিচয় হয় রিফিউজি বা জিরাতি প্রজা। পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ কখনো সম্পত্তি হারা এসব মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। মানুষ গতর খেটেই নিজে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে। ভবিষ্যতেও অবশ্যই বাঙালি নিজেই নিজের মুক্তির পথ রচনা করবে।
নাসির উদ্দিনঃ সাংবাদিক ও লেখক। ফেইস বুক থেকে।


